My Blog My World

Collection of Online Publications

পাকিস্তানি বাহিনী একা গণহত্যা চালায়নি : ড. কাস্টার্স

মেহেদী হাসান

(নিবন্ধটি ১৯ জুন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে। কালের কণ্ঠের ওয়েবসাইটে নিবন্ধটি পড়তে ক্লিক করুন)

নেদারল্যান্ডসের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. পিটার কাস্টার্স বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে এ দেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা ইতিহাসে বিরল। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও তা বলা আছে। নিহতরা মূলত ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক। পাকিস্তানি বাহিনী একা এই গণহত্যা চালায়নি। এই ভূখণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীও এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।’ কাস্টার্সের মতে, যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে অন্য কোনো অপরাধের তুলনা হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার যেকোনো দেশেরই জাতীয় ইস্যু। কারোরই এ বিচারের বিরোধিতা করা উচিত নয়।
বিশ্বশান্তি, ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার পক্ষে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে পিটার কাস্টার্স ঢাকায় এসেছেন। আগামী রবিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে এ সম্মেলন।
১৯৭৩ সালে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন কাস্টার্স। তখন তিনি ছাত্র। ব্যক্তিগত আগ্রহের পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন এ দেশ নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিয়ে সে বছরই আবার তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে অবস্থানকালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার পাশাপাশি এ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমনি সাক্ষী হয়ে আছেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের।
পঁচাত্তরের পর যুদ্ধাপরাধীরা প্রতিষ্ঠা পায় : কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. পিটার কাস্টার্স বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসে দেখেছি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর নানা অপরাধের সহযোগীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ আছে। তখন সবাই জানত, কারা একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাসহ নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতরা শেখ মুজিবুর রহমানের পরবর্তী সামরিক শাসকদের আমলে নিজেদের প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়।’
রাজনৈতিক অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, ‘আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো_শেখ মুজিব-পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো পশ্চিমা শক্তিগুলোর সমর্থনে দেশ পরিচালনা করেছে। অগণতান্ত্রিক উপায়ে কয়েকটি সরকার এলেও এ ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তিগুলোর কোনো আপত্তি ছিল না। তারা এ দেশের সামরিক সরকারগুলোকে যা খুশি তাই করার সুযোগ দিয়েছিল। এর ফলে সামরিক সরকারগুলোর আশীর্বাদে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠাই করেনি, পরে ক্ষমতায়ও এসেছে।’
জোট আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখেছি : কাস্টার্স বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার করা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বদলে বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। সরকারে নিজামী-মুজাহিদদের অংশ নেওয়ার যে বাস্তবতা নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত হতাশার। এর ফল যে নেতিবাচক তা আমরা নিজামী-মুজাহিদদের জোট সরকারের আমলে দেখেছি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। ১৯৭১ সালের মতোই মুসলমান না হলেই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ভিন্ন চোখে দেখা, আক্রমণ করার মতো ঘটনা ওই সরকারের আমলে ঘটেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রশাসনের চোখে মুসলমানদের মধ্যে আহমদিয়াদের আলাদা করে দেখার সংস্কৃতি। এর জন্য দায়ী ছিল মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।’
শোষকরা ধর্মকে ব্যবহার করে : আন্তর্জাতিক এই ব্যক্তিত্ব বলেন, ‘ইতিহাস শিক্ষা দিচ্ছে, যারা জনগণকে শোষণ করতে চায়, তাদের অনেকেই মনে করে, ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসকরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এ দেশের মূল চরিত্র বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে তারা যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে।’
মুজিব হত্যায় আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিল : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে ছিলেন পিটার কাস্টার্স। সে সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এই ভূখণ্ডের জনগণকে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত সংবিধানে প্রগতিশীল আদর্শ ও নীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য তা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা এ দেশে বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবাহের সুযোগ চেয়েছিল। তাই তারা এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পরিবর্তন চেয়েছিল।’
পিটার আরো বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওই আমল ছিল স্বল্প সময়ের। এরপর আমরা দেখেছি, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করা হয়েছে।’
বাধা আছে নানা দিক থেকে : যুদ্ধাপরাধের বিচারের পথে বাধা প্রসঙ্গে পিটার কাস্টার্স বলেন, ‘নানা দিক থেকে বাধা আছে। বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীল অনেক শক্তি আছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না। যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা কোনো দিনই এ বিচার চাইবে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে আরো কিছু শক্তি আছে, যারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, সহযোগিতা দিচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কিছু শক্তি আছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে নয়।’
পিটার বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তিনবার বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সমর্থন করে প্রস্তাব এনেছে। তারপরও আমরা ইউরোপের বিভিন্ন সরকার, পার্লামেন্ট সদস্য ও এনজিওগুলোর সঙ্গে আলোচনার সময় দেখছি, হয় তারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ সম্পর্কে অবগত নয়, কিংবা এ নিয়ে আলোচনা করতে তারা বিব্রতবোধ করে। তাদের শঙ্কা, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাধা আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিচারের প্রতি সমর্থন দিয়ে বেকায়দায় পড়তে পারে ইউরোপ।’
ইউরোপের সমর্থন দরকার : যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করতে বিলম্ব হওয়া প্রসঙ্গে পিটার কাস্টার্স বলেন, ‘বিচার শুরু করতে একদিকে যেমন আইনগত প্রস্তুতি দরকার, অন্যদিকে দরকার রাজনৈতিক প্রস্তুতিও। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার, যাতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কমিশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন আদায় করতে হবে বাংলাদেশকে।’
অনেক বড় প্রক্রিয়া : যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করতে সরকার যে সময় নিচ্ছে তাকে বিলম্ব বলতে নারাজ পিটার কাস্টার্স। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। এটি অনেক বড় একটি প্রক্রিয়া। যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে অনেক বছর আগে। অনেক প্রমাণ এরই মধ্যে নষ্ট হয়েছে। আরো বড় বিষয় হলো, যুদ্ধাপরাধীরা এখন প্রতিষ্ঠিত। তারা ক্ষমতায় থাকার সময় আলামত ও প্রমাণ নষ্ট করেছে। এখন যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহের দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির। সরকারকে তার প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিতে পারে।’
অভিযোগ উঠলে গ্রেপ্তার করা যায় : যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রস্তুতির সময় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অবাধ চলাফেরার সুযোগ থাকা উচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সরকারের বিবেচনার বিষয়। কিন্তু জোরালো অভিযোগ থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ইউরোপে আমার অভিজ্ঞতা হলো_যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠলে যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়।’

June 19, 2010 - Posted by | Crime, Foreign Affairs, Interview | , ,

No comments yet.

Leave a comment